আদম (আ:) সৃষ্টি, জ্ঞান ও ইবলিশের অবাধ্যতা। সুরা বাকারা তাফসির

আদম (আ.) সৃষ্টির গল্প: জ্ঞান ও ইবলিসের অস্বীকৃতি (সূরা বাকারা: ৩০-৩৪ আয়াত)


আল্লাহ তায়ালা যখন এই বিশাল মহাবিশ্ব সুনিপুণভাবে সাজালেন, তখন তিনি পৃথিবীতে এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এক নতুন প্রাণের সূচনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন – সেই প্রাণ হলো মানবজাতি। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ৩০ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে আদম (আ.) এর সৃষ্টি, তাকে দেওয়া বিশেষ জ্ঞান এবং ইবলিসের অবাধ্যতার এক চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায়। এই আয়াতগুলি কেবল একটি ঐতিহাসিক বিবরণ নয়, বরং মানুষের মর্যাদা, জ্ঞানের অপরিহার্যতা এবং অহংকারের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মূল্যবান শিক্ষা বহন করে। তাফসীরে ইবনে কাসীর এবং তাফসীরে জালালাইন এই আয়াতগুলোর গভীর ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা আমাদের এই মহিমান্বিত ঘটনার প্রতিটি দিক গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

১. সৃষ্টির ঘোষণা ও ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা (সুরা বাকারা, আয়াত ৩০)

মহান আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন:

"আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।" [বাকারা আয়াত:৩০]

তাফসীরে ইবনে কাসীর এই 'খলিফা' শব্দটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলে যে, এর দ্বারা এমন একজন প্রতিনিধিকে বোঝানো হয়েছে, যিনি পৃথিবীতে আল্লাহর আইন ও আদেশ কার্যকর করবেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমস্ত সৃষ্টির তত্ত্বাবধায়ক হবেন। ফেরেশতারা আল্লাহর এই ঘোষণায় কিছুটা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন:

"আপনি কি সেখানে এমন সত্তাকে সৃষ্টি করবেন যারা বিশৃঙ্খলা ঘটাবে এবং রক্তপাত করবে? অথচ আমরাই তো সর্বদা আপনার মহিমা কীর্তন করি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি।" [৩০]

তাফসীরে জালালাইন এই জিজ্ঞাসাকে ফেরেশতাদের কৌতূহল হিসেবে ব্যাখ্যা করে, কোনো রকম আপত্তি হিসেবে নয়। হয়তো তারা পৃথিবীতে ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া কোনো বিশৃঙ্খলার অভিজ্ঞতা থেকে এমন ধারণা করেছিলেন, অথবা নিজেদেরকেই আল্লাহর ইবাদত ও তাসবীহ পাঠের জন্য যথেষ্ট মনে করেছিলেন। কিন্তু এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা দৃঢ়ভাবে বললেন:

"নিশ্চয়ই আমি এমন বিষয় জানি যা তোমরা জানো না।" [সুরা বাকারা আয়াত:৩০]

এই আয়াতটি মানুষের সীমিত জ্ঞান এবং আল্লাহর অসীম, সর্বব্যাপী জ্ঞানের দিকে ইঙ্গিত করে। মানব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর যে গভীর উদ্দেশ্য নিহিত ছিল, তা ফেরেশতাদের উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না।

২. আদম (আ.)-কে জ্ঞান দান (আয়াত ৩১-৩৩)

অতঃপর, আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)-কে সমগ্র সৃষ্টির নামসমূহ শিক্ষা দিলেন:

"আর তিনি আদমকে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন।" [আয়াত:৩১]

তাফসীরে ইবনে কাসীর এই 'সকল বস্তুর নাম' দ্বারা কেবল বাহ্যিক নাম বোঝায় না, বরং তাদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা এবং কার্যকারিতাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এই অনন্য জ্ঞানই মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের এক অকাট্য প্রমাণ ছিল। এই জ্ঞান প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের সামনে আদম (আ.)-কে উপস্থিত করে বললেন:

"তারপর সেগুলোকে ফেরেশতাদের সামনে পেশ করে বললেন: তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এগুলোর নাম বলে দাও।" [২:৩১]

ফেরেশতারা তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অকপটে স্বীকার করে বললেন:

"তাঁরা নিবেদন করলেন: আপনি মহাপবিত্র! আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ব্যতীত আমাদের আর কোনো জ্ঞান নেই। নিঃসন্দেহে আপনিই সর্বজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞানী।" [আয়াত:৩২]

তাদের এই বিনয়ী স্বীকারোক্তির পর আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন:

"তিনি (আল্লাহ) বললেন: হে আদম! তুমি তাদেরকে এগুলোর নাম বলে দাও। যখন সে (আদম) তাদেরকে সেগুলোর নাম বলে দিল, তখন তিনি (আল্লাহ) বললেন: আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত এবং যা তোমরা প্রকাশ করো ও যা গোপন করো, তাও আমি জানি?" [আয়াত:৩৩]

এই ঘটনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমন বিশেষ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা তাদের পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা প্রদান করে। জ্ঞানই প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের মূল ভিত্তি।

৩. ফেরেশতাদের সিজদা ও ইবলিসের অস্বীকৃতি (আয়াত ৩৪)

আদম (আ.)-কে এই অতুলনীয় জ্ঞান দান করার পর আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের প্রতি নির্দেশ দিলেন:

"এবং যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম: আদমকে সিজদা করো, তখন তারা সকলেই সিজদা করল, ইবলিস ব্যাতীত। সে অস্বীকার করল, অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।" [আয়াত:৩৪]

তাফসীরে জালালাইন ব্যাখ্যা করে যে, এই সিজদা ছিল আদম (আ.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য, কোনো উপাসনার উদ্দেশ্যে নয়। এটি ছিল আল্লাহর নির্দেশ মানার একটি পরীক্ষা। সমস্ত ফেরেশতা বিনীতভাবে আল্লাহর আদেশ পালন করলেন, কিন্তু জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত ইবলিস এই নির্দেশ অমান্য করল।

ইবলিসের অস্বীকৃতির কারণ:

তাফসীরে ইবনে কাসীর বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে যে, ইবলিসের অবাধ্যতার মূল কারণ ছিল তার অহংকার (تكبر) এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা (استكبار)। সে নিজেকে আদম (আ.)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করত এই যুক্তিতে যে, সে আগুন দিয়ে তৈরি আর আদম (আ.) মাটি দিয়ে তৈরি। তার এই অহংকারই তাকে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতে প্ররোচিত করে, যার ফলস্বরূপ সে আল্লাহর অবাধ্য এবং কাফিরদের দলে শামিল হয়ে গেল। এই ঘটনা অহংকারের ভয়াবহ পরিণতি এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

উপসংহার

আদম (আ.) সৃষ্টির এই গল্প মানবজাতির মর্যাদা, জ্ঞানের অসীম ক্ষমতা এবং অহংকার ও অবাধ্যতার করুণ পরিণতি সম্পর্কে এক চিরন্তন শিক্ষা দেয়। এই আয়াতগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ জ্ঞান ও প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। একই সাথে, ইবলিসের ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, অহংকার এবং আল্লাহর নির্দেশের অবাধ্যতা মানুষকে কিভাবে পতন ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে বিনয়ী হতে, জ্ঞান অন্বেষণ করতে এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url