৩২ কোটি কিমি পাড়ি: NASA যেভাবে গ্রহাণু থেকে মাটি এনে প্রাণের রহস্য খুঁজছে

এক মুঠো মহাজাগতিক ধূলিকণা: যেভাবে NASA প্রাণের রহস্য নিয়ে ফিরল


ভূমিকা:

আমাদের শেকড় কোথায়? এই পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম স্পন্দন কীভাবে জেগে উঠেছিল? এই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞান এক মহাকাব্যিক যাত্রা সম্পন্ন করেছে। NASA-র OSIRIS-REx নামক একটি মহাকাশযান মহাকাশের অনন্ত শূন্যতা পাড়ি দিয়ে বেনু নামের এক আদিম গ্রহাণুর বুক থেকে মহাজাগতিক ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায় পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে।

মহাকাশের টাইম ক্যাপসুল: কেন গ্রহাণু এত গুরুত্বপূর্ণ?

বিজ্ঞানীরা গ্রহাণু এবং উল্কাপিণ্ড নিয়ে এতটা আগ্রহী কেন? কারণ এগুলো হলো সৌরজগতের জন্মের সময়ের অবিকৃত নমুনা। প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে যখন আমাদের সৌরজगत তৈরি হচ্ছিল, তখন গ্রহগুলো তৈরি হওয়ার পর যে অতিরিক্ত পাথর এবং ধূলিকণাগুলো অবশিষ্ট ছিল, সেগুলোই হলো গ্রহাণু। এগুলো মহাকাশের হিমশীতল পরিবেশে কোটি কোটি বছর ধরে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই এগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা জানতে পারি, আমাদের সৌরজগতের শৈশব কেমন ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই গ্রহাণুগুলো "কার্বন যৌগ" এবং "অ্যামিনো অ্যাসিড"-এর মতো জৈব অণু বহন করে, যা পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

লক্ষ্যবস্তু বেনু: এক রহস্যময় অতিথি

এই ঐতিহাসিক মিশনের জন্য NASA যে গ্রহাণুটিকে বেছে নিয়েছিল, তার নাম বেনু (Bennu)। এটি প্রায় ৪৯০ মিটার চওড়া এবং এর পৃষ্ঠ কার্বন যৌগে পরিপূর্ণ, যা জীবনের সম্ভাব্য উপাদানের ইঙ্গিত দেয়। এর আদিম গঠন এবং প্রাণের মূল উপাদানের সম্ভাব্য অস্তিত্বের কারণেই বেনু ছিল এই মিশনের জন্য আদর্শ লক্ষ্যবস্তু।

OSIRIS-REx: সাত বছরের এক মহাকাব্যিক যাত্রা

এটি ছিল প্রকৌশল এবং বিজ্ঞানের এক অসাধারণ বিজয়। এই মহাজাগতিক যাত্রার সূচনা হয়েছিল ২০১৬ সালে। মহাকাশে প্রায় দুই বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যানটি ২০১৮ সালে বেনুর দরজায় পৌঁছায়। এরপর শুরু হয় দুই বছরের এক ধৈর্যশীল পর্যবেক্ষণ পর্ব, যা ২০২০ সালের ঐতিহাসিক নমুনা সংগ্রহের জন্য পথ তৈরি করে দেয়। বেনুর পৃষ্ঠ এতটাই অমসৃণ ছিল যে, সেখানে অবতরণ করা অসম্ভব ছিল। তাই বিজ্ঞানীরা এক রুদ্ধশ্বাস "টাচ অ্যান্ড গো" কৌশল নেন, যেখানে মহাকাশযানটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেনুর পৃষ্ঠকে স্পর্শ করে এবং নাইট্রোজেন গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত পিছিয়ে আসে। অবশেষে, সাত বছরের সফর শেষে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, সেই অমূল্য নমুনা বহনকারী ক্যাপসুলটি পৃথিবীতে নিরাপদে নেমে আসে।

এক মুঠো ধূলিকণায় প্রাণের গোপন সূত্র

ক্যাপসুলটি খোলার পর বিজ্ঞানীরা যা পেয়েছেন, তা ছিল অকল্পনীয়। প্রাথমিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যুগান্তকারী সব তথ্য:

  • প্রাণের বর্ণমালা: নমুনায় পাওয়া গেছে জীবনের জন্য অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড এবং ডিএনএ ও আরএনএ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচটি নিউক্লিওটাইড বেস। সহজ কথায়, প্রাণের জেনেটিক কোড লেখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বর্ণমালাই বেনুর মাটিতে উপস্থিত।
  • জলের উৎস: এতে এমন খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে, যা শুধুমাত্র জলের উপস্থিতিতেই তৈরি হতে পারে। এটি এই শক্তিশালী তত্ত্বকে সমর্থন করে যে, পৃথিবীর বিপুল জলরাশি হয়তো কোটি কোটি বছর আগে এই ধরনের গ্রহাণুর মাধ্যমেই এসেছিল।

এই আবিষ্কারগুলো প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদানগুলো মহাকাশ থেকেই এসেছিল।

আরো পড়ুন

পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস: ৪৫০ কোটি বছরের এক অবিশ্বাস্য মহাজাগতিক ভ্রমণ

মহাবিশ্বে এত গ্রহ, তবে এলিয়েন কোথায়? ফার্মি প্যারাডক্সের গভীর রহস্য

মহাবিশ্বের শেষ রহস্য: যা জানলে আপনার রাতের ঘুম হারাবে!

কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা

প্রশ্ন ১: OSIRIS-REx নামের পেছনে আসল রহস্যটা কী?

উত্তর: এই নামটি আসলে একটি অ্যাক্রোনিম, যা এর প্রধান কাজগুলোকে বর্ণনা করে: Origins (উৎস), Spectral Interpretation (বর্ণালী বিশ্লেষণ), Resource Identification (সম্পদ শনাক্তকরণ), Security (নিরাপত্তা) এবং REx হলো Regolith Explorer (শিলাচূর্ণ अन्वेषक)।

প্রশ্ন ২: এই মিশনের বাজেট কেমন ছিল?

উত্তর: এই উচ্চাভিলাষী অভিযানের পেছনে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশাল বাজেট বরাদ্দ ছিল, যা এটিকে ইতিহাসের অন্যতম ব্যয়বহুল নমুনা-প্রত্যাবর্তন মিশনে পরিণত করেছে।

শেষ কথা: মহাবিশ্বের এক নতুন অধ্যায়

এই মিশনের সাফল্য শুধু ভিনগ্রহের মাটি পৃথিবীতে আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের নিজেদের উৎসের ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় উন্মোচনের মতো। বেনুর প্রতিটি কণা যেন সৌরজগতের শৈশবের এবং পৃথিবীতে প্রাণের সূচনার এক জীবন্ত সাক্ষী, যা আমাদের অস্তিত্বের গল্প নতুন করে বলার সুযোগ করে দিয়েছে। এই অভিযানটি মানবজাতির অদম্য কৌতূহল এবং অজানাকে জানার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url