ইউরিক অ্যাসিড: নীরব ঘাতক ও ৭টি (মারাত্মক ক্ষতি-প্রতিরোধের উপায়।)

ইউরিক অ্যাসিড: নীরব ঘাতক, লক্ষণ প্রকাশের আগেই যেভাবে শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে - ৭টি গুরুত্বপূর্ণ উপায়



আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্রমশ বাড়ছে। তবে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা আছে যা নীরবে আমাদের শরীরের ক্ষতি করে চলে, আমরা টেরও পাই না। এমন একটি নীরব ঘাতক হলো ইউরিক অ্যাসিড (Uric Acid)। প্রায়শই এর গুরুতর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়, ততদিনে শরীরের ভেতরে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে এই ইউরিক অ্যাসিড আমাদের অজান্তেই শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে? আসুন, ইউরিক অ্যাসিডের নীরব ক্ষতির ৭টি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং তা প্রতিরোধের উপায়গুলো জেনে নিই।

ইউরিক অ্যাসিড কী এবং কেন এটি বাড়ে?

ইউরিক অ্যাসিড হলো পিউরিন নামক রাসায়নিক পদার্থের ভাঙ্গনের ফলে উৎপন্ন একটি প্রাকৃতিক বর্জ্য পণ্য। আমাদের শরীর প্রাকৃতিকভাবে পিউরিন তৈরি করে, এবং কিছু খাবার যেমন লাল মাংস, সামুদ্রিক খাবার ও নির্দিষ্ট কিছু পানীয়তেও পিউরিন থাকে। সাধারণত কিডনি এই ইউরিক অ্যাসিডকে ফিল্টার করে মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। কিন্তু যখন কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না অথবা শরীরে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, তখন এটি রক্তে জমা হতে শুরু করে এবং হাইপারইউরিসেমিয়া (Hyperuricemia) নামক অবস্থার সৃষ্টি করে।


লক্ষণ প্রকাশের আগেই ইউরিক অ্যাসিডের ৭টি নীরব ক্ষতি:

  1. জয়েন্ট ড্যামেজ ও গাউট (Gout): এটি ইউরিক অ্যাসিডের সবচেয়ে পরিচিত পরিণতি। উচ্চ ইউরিক অ্যাসিড রক্তে ক্রিস্টাল বা স্ফটিকে পরিণত হয়ে জয়েন্টগুলোতে, বিশেষ করে পায়ের বুড়ো আঙুলের জয়েন্টে জমা হয়। শুরুতে কোনো ব্যথা না থাকলেও, ধীরে ধীরে এটি জয়েন্টগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পরবর্তীতে তীব্র ব্যথা, ফোলা ও প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা গাউট নামে পরিচিত।
  2. কিডনি পাথরের ঝুঁকি বৃদ্ধি: রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকলে তা কিডনিতে ইউরেট ক্রিস্টাল তৈরি করতে পারে, যা পরবর্তীতে কিডনি পাথরে রূপান্তরিত হয়। এই পাথরগুলো প্রস্রাবের পথে বাধা সৃষ্টি করে তীব্র ব্যথা এবং কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী অবস্থায় এটি কিডনি ড্যামেজও করতে পারে।
  3. কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস (Chronic Kidney Disease - CKD): শুধুমাত্র পাথর নয়, রক্তে উচ্চ ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা সরাসরি কিডনির সূক্ষ্ম ফিল্টারিং ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিনের উচ্চ ইউরিক অ্যাসিড কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং এর অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে, যা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা CKD-এর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
  4. উচ্চ রক্তচাপের সাথে সম্পর্ক: কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে উচ্চ ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা উচ্চ রক্তচাপের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, বিশেষ করে কম বয়সীদের মধ্যে। যদিও সরাসরি কারণ ও ফলাফল সম্পর্ক এখনও সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত নয়, তবে ইউরিক অ্যাসিড রক্তনালীগুলির কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে রক্তচাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
  5. মেটাবলিক সিন্ড্রোমের কারণ: ইউরিক অ্যাসিড মেটাবলিক সিন্ড্রোমের একটি অংশ হতে পারে, যা একসাথে বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য সমস্যার জন্ম দেয়। এর মধ্যে রয়েছে স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ রক্তে শর্করা এবং অস্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রা। এই সিন্ড্রোম হৃদরোগ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
  6. হৃদরোগের ঝুঁকি: উচ্চ ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি রক্তনালীর প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সৃষ্টি করতে পারে, যা ধমনী শক্ত হয়ে যাওয়া (এথেরোস্ক্লেরোসিস) এবং হৃদরোগের কারণ।
  7. ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও ডায়াবেটিস: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ ইউরিক অ্যাসিড ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেখানে শরীর ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এটি দীর্ঘমেয়াদে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

কীভাবে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করবেন?

লক্ষণ প্রকাশের আগেই ইউরিক অ্যাসিডের নীরব ক্ষতি এড়াতে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য:

  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন - লাল মাংস, অর্গান মিট (কলিজা), সামুদ্রিক খাবার (স্যালমন, সার্ডিন), উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপযুক্ত পানীয় এবং অ্যালকোহল (বিশেষ করে বিয়ার) পরিহার করুন বা সীমিত করুন। প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি, শস্য এবং কম ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করুন।
  • পর্যাপ্ত জল পান: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন। এটি ইউরিক অ্যাসিডকে মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্থুলতা ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির একটি কারণ। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত শরীরচর্চা মেটাবলিজম উন্নত করে এবং ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • কার্বনেটেড পানীয় পরিহার: চিনিযুক্ত পানীয় এবং কোমল পানীয় (সফট ড্রিঙ্কস) রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে।
  • নির্দিষ্ট ঔষধের ব্যবহার: কিছু ঔষধ ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে বিকল্প ঔষধ বা মাত্রা পরিবর্তন করা যেতে পারে।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বিশেষ করে যদি আপনার পরিবারে ইউরিক অ্যাসিড বা গাউটের ইতিহাস থাকে, তাহলে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা জেনে নিন এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

উপসংহার:

ইউরিক অ্যাসিডের নীরব ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। যখন ব্যথা বা অন্যান্য গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই, সুস্থ জীবনযাপন, সচেতন খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এই নীরব ঘাতককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিন এবং সুস্থ থাকুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url