সৎ কাজে আদেশ অসৎ কাজে নিষেধ, ইসলামিক দায়িত্ব২০২৫
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ – কুরআন ও হাদীসের আলোকে
🔰 ভূমিকা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এ ধর্ম কেবল ইবাদত ও রীতিনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং মানবজীবনের প্রতিটি দিকের নির্দেশনা দিয়েছে। সমাজ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো — সৎ কাজের আদেশ (আমর বিল মা'রুফ) এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ (ওয়া নাহি আনিল মুনকার)।
হে মুসলিম তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি মানবজাতির মধ্যে আবির্ভূত হয়েছো তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও অসৎ কাজে নিষেধ কর আল্লাহকে বিশ্বাস করো যদি সৎ কাজের নির্দেশ না দাও অসৎ কাজে নিষেধ না করো তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার যোগ্য না তাহলে কোরআনের এই আয়াত অনুযায়ী আপনি সৎ কাজের নির্দেশ দিবেন অসৎ কাজে নিষেধ করবেন বেহেশতে যাওয়ার জন্য একজন মুসলিমকে যে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে সেগুলো বলা আছে (সূরা আছরে আয়াত ১ থেকে ৩) ওয়াল আসরি ইন্নাল ইনসানা লাফী খুসর । ইল্লাল্লাযিনা আমানু ওয়া ‘আমিলুস সালিহাত। ওয়া তাওয়া সাও বিল হাক্কি ওয়া তাওয়া সাও বিস্ সব্র ।
অর্থাৎ মহাকালের শপথ মানুষ সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা বাদে যারা ঈমান আনে যারা সৎ কাজ করে যারা মানুষকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং মানুষকে ধৈর্য ও অধ্যাবসায়ের উপদেশ দিয়ে থাকে কোন মানুষ বেহেশতে যেতে চাইলে চারটা শর্ত পূরণ করতে হবে ঈমান। সৎ কাজ করা ।মানুষকে সত্যের উপদেশ দেওয়া ।মানুষকে ধৈর্য অধ্যাবসায়ের উপদেশ দেওয়া এই চারটার একটাও বাদ গেলে বেহেস্তে যেতে পারবেন না হয়তো আপনি খুব ভালো মুসলিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন হজ পালন করে এসেছেন নিয়মিত জাকাত দেন কিন্তু যদি দাওয়াত না দেন সৎকাজের নির্দেশ অসৎ কাজে নিষেধ না করেন আপনি বেহেস্তে যেতে পারবেন না যদি আল্লাহ ক্ষমা করে বেহেশতে পাঠান সেটা আলাদা ব্যাপার এটা তার এখতিয়ার। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন আল্লাহ চাইলে যেকোনো অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন তবে শিরিক এর অপরাধ কখনো ক্ষমা করবেন না সাধারণ পরিস্থিতিতে এই চারটা জিনিসই সমান গুরুত্বপূর্ণ ঈমান সৎ কাজ করা মানুষকে সত্যের উপদেশ দেওয়া এবং ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের উপদেশ দেওয়া।
এই দায়িত্ব কেবল আলেম বা ইমামদের নয়, বরং প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব। এটি পালনের মাধ্যমেই একটি সমাজ সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও আলোকিত হতে পারে।
📖 কুরআনের আলোকে নির্দেশনা
১. শ্রেষ্ঠ উম্মতের বৈশিষ্ট্য
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদেরকে মানবজাতির জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কর এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ।”
— (সূরা আলে ইমরান: ১১০)
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন তোমাদের মধ্যে যদি কেউ কোন মন্দ কাজ দেখতে পায় সে যেন তার নিজ হাত দিয়ে পরিবর্তন করে যদি না পারে তাহলে মুখ দিয়ে বলার দ্বারা পরিবর্তন করে আর যদি সেটাও না পারে তাহলে অন্তরে ঘৃণা করে আর এটি হলো ঈমানের দুর্বলতম স্তর (মুসলিম:49)
২. ব্যর্থ জাতির চিত্র
“তারা একে অপরকে যে মন্দ কাজ করত, সে থেকে বিরত রাখত না। তারা যা করত, তা কতই না নিকৃষ্ট।”
— (সূরা মায়েদা: ৭৯)
আয়াতে যে বক্তব্যটি তুলে ধরা হয়েছে সেটি হল সূরা আল মায়েদা আয়াত ৭৯ এর একটি হৃদয়বিদারক বর্ণনা। এটি এক ব্যর্থ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির ইতিহাস তুলে ধরেছে। যারা সমাজে অন্যায় চলতে দেখেও কিছু করত না এই আয়াতে ইহুদী জাতির কথা বলা হয়েছে। যারা নবী রাসূলদের অমান্য করেছিল এবং সমাজে অপরাধ মন্দ কাজ অবাধে চলতে দিয়েছিল। যখন তারা পরস্পরের অন্যায়ের প্রতিবাদ বন্ধ করে দিল তখনই তাদের উপর আল্লাহর গজব নেমে আসলো।
- তারা একে অপরের ভুল ও অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করত না।
- সমাজে অনৈতিকতা ও দুর্নীতি খুবই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।
- ধর্মের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তারা মুখ বন্ধ করে চুপচাপ ছিল।
- নাফারমানি ও গুনাহে লিপ্ত ছিল।
এই আয়াত আমাদের জন্য একটি কঠিন সতর্কবার্তা। কারণ এটি বোঝায়:
যদি কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে তবে সে অন্যায়কারীর অংশীদার হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, যখন কোন জাতির মাঝে গুনাহ ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা কেউ কাউকে গুনাহ থেকে নিষেধ না করে তখন আল্লাহর সবাইকে একসাথে শাস্তি দেন।(আবু দাউদ ৪৩৩৮)
৩. সফলতার শর্ত
“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, তারা একে অপরকে উপদেশ দিয়েছে সত্য ও ধৈর্যের পথে।”
— (সূরা আসর: ৩)
সূরা আসর মাত্র তিনটি আয়াত নিয়ে গঠিত। কিন্তু এর গভীরতা ও তাৎপর্য এতটাই বিস্তৃত যে অনেক সাহাবী বলতেন:
এ সূরা যদি শুধু একাই নাযিল হতো তবুও তা মানুষের জন্য হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট হতো। (ইমাম শাফি রহ:) বলেন।
আয়াত তিনটির মূল শর্ত সমূহ ঈমান সৎকর্ম একে অপরকে সত্যের উপদেশ দেওয়া একে অপরকে ধৈর্যের উপদেশ দেওয়া
এই চারটি গুণ যার মধ্যে থাকবে তিনি আসল সফল ব্যক্তি। বাকিরা ক্ষতির মধ্যে রয়েছে এটাই আল্লাহর ঘোষণা।
১. ইমানের স্তর অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া
“তোমাদের কেউ যদি কোনো মন্দ কাজ দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে। যদি তা না পারে, তবে মুখে প্রতিবাদ করুক। তাও যদি না পারে, তাহলে অন্তরে ঘৃণা করুক — আর এটি হচ্ছে ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।”
— (সহীহ মুসলিম: ৪৯)
২. উপদেশ না দিলে শাস্তি
“আল্লাহর কসম! তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো, তবে আল্লাহ তোমাদের উপর এমন শাস্তি পাঠাবেন যে, তখন তোমরা দোয়া করলেও তা কবুল হবে না।”
— (তিরমিযি: ২১৬৯)
🔍 এই দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব
- নাফরমানি রোধ হয় ও সমাজ শুদ্ধ থাকে।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভ হয়।
- মুসলমানদের ঈমান শক্তিশালী হয়।
- ফিতনা-ফাসাদ কমে যায়।
🤲 কীভাবে আদেশ ও নিষেধ করা উচিত?
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে গেলে কিছু নিয়ম-কানুন মানা জরুরি।
- হিকমাহ বা প্রজ্ঞা দিয়ে কথা বলা উচিত।
- সতর্কভাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দাওয়াত দিতে হবে।
- বিনয়ী ও সম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করতে হবে।
- নিজেও সেই কাজের উপর আমলকারী হতে হবে।
🛡️ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
মসজিদে কেউ নামাজে গাফিল হলে তাঁকে বলা যায়: “ভাই, নামাজ হচ্ছে মুমিনের মিরাজ, আসুন আমরা সবাই সময়মতো আদায় করি।”
বাজারে অসৎ ব্যবসায়িক আচরণ দেখলে নম্রভাবে বলা যায়: “ভাই, হাদীসে এসেছে- যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”
📚 ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত
রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা ও মদিনায় সর্বদা এই দায়িত্ব পালন করেছেন। সাহাবীগণ বিভিন্ন দেশে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন এবং মন্দ কাজের প্রতিবাদ করেছেন। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি এই আদেশ ও নিষেধ।
🧠 কিছু ভুল ধারণা
- “আমি নিজেই ঠিক না, অন্যকে কী বলবো?” — এটা ভুল। আপনি নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করুন, একই সাথে অন্যকেও উপদেশ দিন।
- “মানুষ তো শুনে না।” — দায়িত্ব হচ্ছে বলা, হিদায়েত দেওয়া আল্লাহর কাজ।
⚠️ সতর্কতা
- নম্র ও দয়ার সাথে উপদেশ দেওয়া।
- জ্ঞান ও প্রমানের ভিত্তিতে কথা বলা।
- নিজে আগে সে সৎ কাজটি পালন করা।
- পরিস্থিতি বুঝে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে বলা।
- ধৈর্য ও সহনশীলতা রাখা
- উপদেশ যেন কাউকে হেয় বা অপমান করে না।
- আত্মপ্রশংসা যেন না থাকে।
- জোর-জবরদস্তি বা কটুভাষা যেন না হয়।
🌟 উপসংহার
“সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ” ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষার অংশ। এর মাধ্যমে সমাজে ন্যায়, ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন মুসলমানের উচিত, সে নিজেও সৎ পথে চলবে এবং অন্যকে সেই পথে আহ্বান করবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই এবং একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনে অবদান রাখি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url