ব্যাভিচার (যিনা) থেকে আত্মরক্ষা: ইসলামে পবিত্র জীবনের নির্দেশনা

ব্যভিচার (যিনা) থেকে আত্মরক্ষা: ইসলামে পবিত্র জীবন ধারণের গুরুত্ব


মানবতার জন্য আল্লাহ তায়ালা যে জীবনবিধান পাঠিয়েছেন, তাতে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক পবিত্রতা রক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে নানা প্রসঙ্গে মানুষের জন্য নৈতিকতার সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ব্যভিচার বা 'যিনা' অন্যতম গুরুতর পাপ। এই পাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সূরা নিসার ১৫ থেকে ১৭ আয়াতে এই বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে, যা আমাদের জন্য শিক্ষা ও সতর্কবার্তা বহন করে।

ব্যভিচার (যিনা) কী এবং এর গুরুতরতা

ইসলামে ব্যভিচার (যিনা) বলতে বোঝায় বিবাহবহির্ভূত অবৈধ যৌন সম্পর্ক। এটি শুধু শারীরিক সম্পর্ক নয়, বরং এর সাথে জড়িত প্রতিটি পদক্ষেপ, যেমন - অশ্লীল দৃষ্টি, অবৈধ স্পর্শ, নির্জনে অবস্থান, এবং কুমন্ত্রণাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ইসলামে যিনাকে 'ফাহিশা' (অশ্লীলতা) এবং 'শুনুন' (মন্দ পথ) বলা হয়েছে, যা এর গুরুতরতা প্রমাণ করে।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন:

"وَاللاَّتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِن نِّسَآئِكُمْ فَاسْتَشْهِدُواْ عَلَيْهِنَّ أَرْبَعَةً مِّنكُمْ فَإِن شَهِدُواْ فَأَمْسِكُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ حَتَّىَ يَتَوَفَّاهُنَّ الْمَوْتُ أَوْ يَجْعَلَ اللّهُ لَهُنَّ سَبِيلاً" [সূরা নিসা ৪:১৫]

(অর্থাৎ: তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচার করে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য হতে চারজন সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত করবে, তবে তারা সাধ্য প্রমাণ করে, তবে তাদের কে গৃহে আবদ্ধ করবে যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু তাদের কে নিয়ে না যায় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য কোন পথ না করে দেন।)

এই আয়াতটি ব্যভিচারের কঠোরতা এবং এর প্রাথমিক শাস্তির ইঙ্গিত দেয়। এটি সমাজের পবিত্রতা এবং পারিবারিক কাঠামো রক্ষার জন্য ইসলামের গুরুত্বকে তুলে ধরে।


পবিত্রতা ও পরকালীন জবাবদিহিতা

ইসলাম শুধু ইহকালীন জীবন নয়, বরং পরকালীন জীবনেরও পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা দেয়। যিনার মতো পাপের পরিণতি শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখিরাতেও ভয়াবহ। তাই মুসলিমদের উচিত নিজেদেরকে সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখা।

আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ১৬ ও ১৭ আয়াতে বলেন:

"وَاللَّذَانِ يَأْتِيَانِهَا مِنكُمْ فَآذُوهُمَا فَإِن تَابَا وَأَصْلَحَا فَأَعْرِضُواْ عَنْهُمَا إِنَّ اللّهَ كَانَ تَوَّابًا رَّحِيمًا" [সূরা নিসা ৪:১৬]

(অর্থাৎ: আর তোমাদের মধ্যে যে দু'জন এতে লিপ্ত হবে, তাদের উভয়কেই শাস্তি দাও। অতঃপর যদি তারা তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়, তবে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।)

"إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوَءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ فَأُوْلَـئِكَ يَتُوبُ اللّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا" [সূরা নিসা ৪:১৭]

(অর্থাৎ: আল্লাহর কাছে তওবা কবুল হয় তাদের, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে, তারপর দ্রুত তওবা করে নেয়। এদেরই তওবা আল্লাহ কবুল করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।)

এই আয়াতগুলো তওবার গুরুত্ব এবং আল্লাহর ক্ষমাশীলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, পাপ করার পর যদি কেউ sincerely অনুতপ্ত হয় এবং ফিরে আসে, তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত।


ব্যভিচার থেকে আত্মরক্ষার উপায়: সুস্থ জীবনের দিকে পদক্ষেপ

ইসলাম শুধু নিষেধই করে না, বরং সুস্থ ও পবিত্র জীবনযাপনের জন্য Practical দিকনির্দেশনাও দেয়।

  • দৃষ্টির সংযম: কুরআনে নারী ও পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি সংযত রাখতে আদেশ করা হয়েছে। অশ্লীল দৃশ্য দেখা থেকে বিরত থাকা যিনার দিকে প্রথম পদক্ষেপ রোধ করে।
  • বিবাহ: ইসলাম বিবাহকে উৎসাহিত করে। যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তাদের দ্রুত বিবাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ এটি নিজেকে পবিত্র রাখার সর্বোত্তম উপায়।
  • নিয়মিত ইবাদত: নামাজ, রোজা, কুরআন তেলাওয়াত ও জিকির মানুষকে আল্লাহর কাছাকাছি রাখে এবং পাপ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
  • ভালো সঙ্গ: ভালো এবং নেককার মানুষদের সাথে সময় কাটালে মন ও চরিত্র পবিত্র থাকে।
  • যৌন শিক্ষার সঠিক ধারণা: ইসলামে বিবাহের মাধ্যমে যৌন চাহিদা পূরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং অবৈধ সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার জন্য পরিষ্কার শিক্ষা রয়েছে।
  • আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ভয়: আল্লাহর ভয় এবং পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতি মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে।

সমাজের ভূমিকা: পবিত্র পরিবেশ বিনির্মাণ

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি সমাজেরও ভূমিকা রয়েছে একটি পবিত্র পরিবেশ গঠনে। অশ্লীলতা ও ফাহিশার বিস্তার রোধ করা সমাজের সকলের দায়িত্ব।

  • পারিবারিক শিক্ষা: পরিবার থেকেই শিশুদেরকে ইসলামিক মূল্যবোধ ও শালীনতার শিক্ষা দিতে হবে।
  • গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা: মিডিয়াকে অশ্লীলতা পরিহার করে গঠনমূলক ও নৈতিক বার্তা প্রচার করতে হবে।
  • আইনের প্রয়োগ: ইসলামী আইন অনুযায়ী ব্যভিচারের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা রোধ করে।

উপসংহার

ব্যভিচার থেকে আত্মরক্ষা করা শুধু ব্যক্তিগত পবিত্রতার বিষয় নয়, বরং এটি একটি সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ গঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলে আমরা নিজেদেরকে এবং আমাদের সমাজকে সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে মুক্ত রাখতে পারি। আল্লাহর ক্ষমা ও রহমতের ওপর ভরসা রেখে, তওবা ও সৎকর্মের মাধ্যমে আমরা পবিত্র জীবন যাপন করতে পারি। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু, কিন্তু যারা জেনেবুঝে পাপে লিপ্ত হয় এবং তওবা করে না, তাদের জন্য কঠিন পরিণতি রয়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url